রবিবার ● ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২১
প্রথম পাতা » সম্পাদকীয় » আমরা শিক্ষিত হচ্ছি, মানুষ হচ্ছিতো?
আমরা শিক্ষিত হচ্ছি, মানুষ হচ্ছিতো?
ইউছুফ আলী মিঠু
মিতালী মুখার্জীর একটি জনপ্রিয় গান- “এ দুনিয়া এখন তো আর সে দুনিয়া নাই- মানুষ নামের মানুষ আছে দুনিয়া বোঝাই”। এখানে গায়ক গানটি কোন অর্থে ব্যবহার করেছেন আমি জানিনা। তবে নামের মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে; এটা কিন্তু সত্য। মানুষ শব্দের বিশ্লেষণ করতে দেখা যায়- মান + হুশ। যার হুশ আছে তিনিই মানুষ। কিন্তু সমাজের চিত্রপট যেনো ভিন্ন কোন ইংগিত করছে আমাদের। প্রশ্ন হচ্ছে এমন অনেকেই বড় হচ্ছে প্রতিনিয়ত। শিখছে অনেক কিছু। পড়ছে উচ্চ শিক্ষা, হচ্ছে কোটিপতি!
এক সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যিনি পাঠদান করতেন বর্তমান সময় এসে তিনি একজন ব্যবসায়ি। বিচিত্র এ পৃথীবিতে প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার লড়াই চলছে। এ লড়াইয়ে সবাই জিততে চায়। কিন্তু আমরা যাদের অনুসরণ কিংবা অনুকরণ করবো এখন তাদের অনুকরণ বা অনুসরণ করার মানে জ্ঞান বিক্রেতা হিসেবে নিজকে উপস্থাপন করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না। আশির দশকে একজন শিক্ষক প্রতিষ্ঠান থেকে যতসামান্য বেতন পেয়ে তার পুরো সংসার চালাতেন। আর এখন সরকার বিভিন্ন স্কেলে শিক্ষকদের বেতন দিলেও তাদের আরো চাই। টিনের ঘর থেকে এসে একজন শিক্ষক প্রতিষ্ঠানের প্রধান হলে ২/৩বছরের মাথায় তিনি দালানের মালিক। তাহলে তার কাছে জ্ঞানদান করা কর্তব্য না হয়ে দুর্নীতি করে বড় হওয়া কর্তব্য মনে হয়।
কী আজব ব্যপার! কেউ ভালো মানুষ হতেই চাচ্ছে না। ১০০ জন শিক্ষার্থীকে যদি বর্তমানে জিজ্ঞেস করা হয় বড় হয়ে কী হতে চাও? ৯৯ জনই বলবে,অমুক ভাইয়ের মত ব্যারিষ্টার, ডাক্তার, পুলিশ কর্মকর্তা, এসপি,ডিসি সহ সম্মানিত কোন ব্যক্তি। কিন্তু আদৌ শিক্ষার্থীরা ভালো মানুষ হতে চাই কথাটা মুখে দিয়ে আনতে কুন্ঠাবোধ করে।
উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আমরা বিভিন্ন সেবামূলক পেশায় জড়াচ্ছি। দুভার্গ্য, সে পেশাকে অনেকেই অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেন। যেমন, ওই প্রসূতি ‘মা’ যার সন্তান ১৫০০ টাকা না দিতে পারার কারনে সন্তান হাসপাতালের বেডে নয়,প্রসব হয় বারান্দায়। প্রতিদিন পত্র-পত্রিকার সংবাদে জানা জায়,দারিদ্রতার কারনেই হাসপাতালে চিকিৎসার সেবা হতে বঞ্চিত হয়েছেন সেই প্রসব যন্ত্রনায় কাতর মা!
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যারা ডাক্তার,ব্যবস্থাপক তাঁরা অবশ্যই শিক্ষার আলোয়, আলোকিত। হয়তো শিক্ষার কোন স্তরে তাঁরা পেয়েছেন যে, সেবা পেতে পয়সা খরচ করা লাগে। প্রতিদিনই মানুষকে জিম্মি করে টাকার হাতিয়ে নেওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। কেউ মুক্তিপন হিসেবে নেয়। কেউ ফাইল আটকিয়ে নেয়। কেউ উচ্চস্থানে অথবা ক্ষমতার মসনদ থাকার জন্য নেয় এবং দেয়। এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের হুশ -জ্ঞান কী আছে, আমরা আসলে কতটা ভালো মানুষ হতে পেরেছি?
জানি এ প্রশ্নের কোন জবাব নেই। রীতিমত আমরা সকল ক্ষেত্রেই এখন টাকাটাকে বড় করে দেখছি। এই যে সারা দেশে, কোচিং, প্রাইভেট বাণিজ্যে বন্ধের সরকারের এত হুশিয়ারী। কিন্তু কয়টা প্রাইভেট, কোচিং বন্ধ হচ্ছে। দিনে-দিনে তা আরো বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি করোনাও আমাদের দমাতে পারেনি। এস্যাইনমেন্টর নামে হাতানো হয়েছে কাড়ি কাড়ি টাকা। পরীক্ষা আসলে ফরমফিলাপ নামক বাড়তি ঝামেলা তো রয়েছেই। শিক্ষাগুরুরা এখন অর্থের কাছে নিজেদের সোপর্দ করেছে।
ক’দিন আগে একটি পত্রিকা থেকে জানতে পারলাম, জাপানে নাকি একাডেমিক(কিন্ডারগার্টেন) লাইফ থেকে তিনটা জিনিস প্রথমেই শেখানো হয় ১ কননিচিওয়া(হ্যালো) ২ আরিগাতোউ(ধন্যবাদ) গোমেনাসাই(দুঃখিত)। তবে কী আমাদের জাপানের শিক্ষা ব্যবস্থা আরম্ভ করা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে?
অর্থাৎ কারো সাথে দেখা হলেই কুশল হিসেবে তাকে বলতে হবে হ্যালো। কারো দ্বারা বিন্দু মাত্র উপকৃত হলে তাকে বলতে হবে ধন্যবাদ। আর কেউ মনে কষ্ট পেলেও তাকে দুঃখিত বলে ক্ষমা চাইতে হবে। আর এজন্যই হয়তো তাঁরা হয় মানবিক। কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যবস্থা তা ভিন্ন। আমরা ক্ষমতার মোহে বা টাকার অহঙ্কারে অন্যকে মানুষ মনে করছিনা। আমরা শিক্ষিত হচ্ছি ঠিকই , দিন দিন মানবিক গুণাবলী হারাতে বসেছি।
আর এই যে হীনমন্যতা এটাই ভবিষতে ভালো মানুষ হওয়ার পথে অন্তরায়। বছর,বছর আমরা পাস করছি আর সার্টিফিকেট বের করছি,আদৌ ভালো মানুষ হওয়ার একখান সার্টিফিকেট ও বের করতে পারি নাই।
ক’দিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড.আতিউর রহমান বলছিলেন, এক সময় ভালো অবকাঠামো ছিলো না, ভালো শিক্ষক ছিলো। এখন অবকাঠামো ভালো, নেই ভালো শিক্ষক। আবার যারা শিক্ষার্থী তাদের মধ্যে ও শিক্ষক ভক্তি হীনতূল্য। অনেক শিক্ষার্থী তো শিক্ষককে শিক্ষকই মনে করে না।
এর কারণ আমরা নৈতিক শিক্ষা থেকে আনেক দুরে। শিক্ষার পরিবেশ ফেরাতে আমাদের শিক্ষকদের নৈতিক মূল্যবোধ থাকা প্রয়োজন এবং কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষা দেওয়া বাধ্যতামূলক।
- লেখক ও সাংবাদিক-
email: [email protected]